বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র ছয় মাসে চার রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ ১০ শতাংশ বেড়ে চলতি বছরের জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা—অর্থাৎ ৯০ শতাংশেরও বেশি—‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত, যেগুলো পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কার্যত নেই।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় যখন দুর্বল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য উদ্ধার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ছে। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি মূলধন ঘাটতি, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে পর্যাপ্ত সংরক্ষণ না থাকা, প্রভিশন ঘাটতি ও মুনাফা কমে যাওয়া—সব মিলিয়ে চার ব্যাংক এখন টালমাটাল অবস্থায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি কেবল মুনাফার নয়, বরং টিকে থাকার সংকট। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি পুনর্গঠন বা একীভূতকরণের মতো কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দ্রুত অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে।
জনতা ব্যাংক: সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়
২০২৫ সালের জুন শেষে জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের ৭৬ শতাংশ খেলাপি—পরিমাণে ৭২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। এর ৯৩ শতাংশ ইতোমধ্যেই ‘খারাপ’ হিসেবে চিহ্নিত। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক –৩.২৫ শতাংশ, যেখানে ন্যূনতম ১২.৫ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। লোকসান কিছুটা কমলেও ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে নেট ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭১ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক: তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায়
সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ জুন শেষে মোট ঋণের ২০ শতাংশ, যা গত ডিসেম্বর ছিল ১৮.২০ শতাংশ। যদিও খেলাপি বেড়েছে, তবু মূলধন পর্যাপ্ততায় সফল হয়েছে ব্যাংকটি। এর ক্যাপিটাল অ্যাডেকুয়েসি রেশিও দাঁড়িয়েছে ১০.১০ শতাংশ, যা ন্যূনতম শর্ত পূরণ করেছে। একই সময়ে ব্যাংকটি নেট মুনাফা করেছে ৫৯১ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংক: বড় খেলাপির বোঝা
অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪০.৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশই ‘খারাপ’ ঋণ। মূলধন পর্যাপ্ততার হার মাত্র ১.৯৭ শতাংশ—যা বাধ্যতামূলক ১২.৫ শতাংশের অনেক নিচে। যদিও প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি ১১৪ কোটি টাকা নেট মুনাফা করেছে, ২০২৪ সালের শেষার্ধে এ খাতে ছিল ৯৩৬ কোটি টাকার ক্ষতি।
রূপালী ব্যাংক: খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়ছে
রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৪৪ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এ হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। খেলাপি ঋণের মধ্যে ৯১ শতাংশই ‘খারাপ’ ঋণ। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততা হার মাত্র ২.৮৬ শতাংশ, যেখানে ন্যূনতম ১২.৫ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। এ সময়কালে নেট মুনাফা হয়েছে মাত্র ৮.৩৪ কোটি টাকা, যা আগের ছয় মাসের ৬৪.৪৯ কোটি টাকার তুলনায় অনেক কম।
বিশেষজ্ঞ মত
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদের মতে, গত ১৫ বছরের লুটপাটের প্রভাব এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। তার মতে, ব্যাংকগুলোর টিকে থাকতে হলে সঠিক কর্পোরেট গভর্নেন্স, সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। নতুন করে সরকারি মূলধন ইনজেকশনের চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা বকেয়া আদায় করলেই অবস্থার উন্নতি সম্ভব।
👉 সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। দ্রুত সংস্কার ছাড়া এগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।