Home মতামতবাংলাদেশের পর এবার নেপালে যেভাবে ‘জেন জি’রা অভ্যুত্থান ঘটাল

বাংলাদেশের পর এবার নেপালে যেভাবে ‘জেন জি’রা অভ্যুত্থান ঘটাল

by Potro News
০ comments

নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কাঠমান্ডুর চলমান এই দৃশ্যগুলো এক বছর আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে যেমন অদ্ভুত সাদৃশ্যপূর্ণ, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ে জনরোষের মুখে সরকারের পতনের সবচেয়ে প্রতীকী উদাহরণ হিসেবে উঠে আসে ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কা।

বাতাসে বারুদের গন্ধ, শহরের চত্বরগুলো তরুণ বিক্ষোভকারীদের ভিড়ে ঠাসা, আর মাথার ওপর হেলিকপ্টারের একটানা গুঞ্জন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন দৃশ্য যেন বারবার ফিরে আসছে। 

জনপ্রিয় আন্দোলনের ঢেউ বহু দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে দিচ্ছে, যা প্রায়শই শেষ হচ্ছে বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অপ্রত্যাশিত পদত্যাগের মাধ্যমে। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও গল্পটা একই রকম: পঙ্গু অর্থনৈতিক দুর্দশা, দীর্ঘদিনের দুর্নীতি এবং ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসনের মিশেলে জনগণ তাদের সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।

এই মুহূর্তে কেন্দ্রবিন্দু কাঠমান্ডু। জেন-জি প্রজন্মের এই বিক্ষোভ কেবল সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধের কারণেই নয়; এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং ক্ষমতাশালীদের সন্তানদের (যাদের বলা হচ্ছে ‘নেপো কিডস’ ও ‘নেপো বেবিজ’) অযাচিত সুযোগ-সুবিধা প্রদান। 

গত কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে সরব ছিলেন নেপালি তরুণেরা। তারা টিকটক, রেডিটসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘নেপো কিডস’, ‘নেপো বেবি’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে পোস্ট করে আসছিলেন। 

এরই মধ্যে গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নেপাল সরকার ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ও মেসেজিং অ্যাপ বন্ধ করে দিলে তরুণদের এই প্রতিবাদ নতুন করে গতি পায়। প্রতিবাদ জানাতে এবার অনলাইন ছেড়ে রাজপথে নামেন হাজার হাজার নেপালি তরুণ। তাদের এই বিক্ষোভ এখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভে রূপ নিয়েছে।

বিতর্কিত নিষেধাজ্ঞা ঘিরে শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুত রূপ নেয় সহিংসতায়। প্রতিবাদকারীরা সংসদ ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এরপরই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় সরকার। সবশেষে আজ মঙ্গলবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেছেন কয়েক সপ্তাহের লাগাতার অস্থিরতার পর। তার আগে সহিংস সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৯ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক।

নেপালে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের এই নাটকীয় মুহূর্তটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কাঠমান্ডুর চলমান দৃশ্যগুলো এক বছর আগে বাংলাদেশের পরিস্থিতি যারা দেখেছেন, তাদের কাছে তা অদ্ভুতভাবে পরিচিত মনে হবে। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। স্বৈরাচারী শাসন, ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রবল দাবির মুখে ঢাকার রাজপথ যেমন বিক্ষোভকারীদের ভিড়ে প্লাবিত ছিল, সরকারি ভবনগুলো অবরোধ করা হয়েছিল এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল–একই চিত্র এখন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে নেপালে। 

নেপালে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার এই নাটকীয় মুহূর্ত এক বছর আগে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মনে করিয়ে দেয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে। কাঠমান্ডুর রাজপথে ‘জেন জি’ প্রজন্মের তরুণরা সরকারি ভবনে হামলা চালাচ্ছিল, কারফিউ অমান্য করছিল এবং কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল—যা গত বছর গনভ্যুত্থানের কথা মনে করিয়ে দেয়।

উভয় দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই ছিল আন্দোলনের মূল কেন্দ্র। ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো দ্রুত জনরোষকে সংগঠিত করে আন্দোলনকে পুরো দেশে ছড়িয়ে দেয়। বিতর্কিত এই ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা নেপালে আগুন আরও উসকে দিয়েছে, আর বাংলাদেশেও একই ধরনের ডিজিটাল সীমাবদ্ধতা জনরোষ বাড়িয়েছিল। এইভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তরুণরা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতাধর নেতাদের পদচ্যুত করতে সক্ষম হয়েছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে জনরোষের মুখে সরকারের পতনের সবচেয়ে প্রতীকী ও দৃশ্যত উদাহরণ সম্ভবত ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কা থেকে উঠে আসে। একসময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত এই দ্বীপরাষ্ট্রটি এক নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হয়। শক্তিশালী রাজাপাকসে পরিবারের দুই দশকের শাসনামলে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, অসহনীয় ঋণ আর ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল এই সংকটের মূল কারণ।

You may also like

Leave a Comment