Home মতামত‘চিটাগং ইন্টারন্যাশনাল অল উইমেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ প্রসঙ্গে

‘চিটাগং ইন্টারন্যাশনাল অল উইমেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ প্রসঙ্গে

by Potro News
০ comments

সেদিক থেকে শহরের চলচ্চিত্র অনুরাগীদের জন্যে দুইদিন ব্যাপী উৎসবটি বড় আনন্দের উৎসার ছিল। অবশ্য বাংলাদেশের শুধুমাত্র নারী চলচ্চিত্রকারদের কেন্দ্র করে আরেকটি আয়োজনের কথা পাওয়া যায় বছর পাঁচেক আগে। 

চট্টগ্রামের আঁলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হলো ‘চিটাগং ইন্টারন্যাশনাল অল উইমেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটি ফিল্ম ক্লাবের সাথে ছিলেন ‘কানেক্ট হার’, ‘ফিল্ম ফর আস’ এর মতো সংস্থা। 

চট্টগ্রামের আঁলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এর পরিচালক ব্রুনো ল্যাক্রাম্প বরাবরের মতোই সকল ধরণের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এটি প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসের বাইরে খানিকটা বড় পরিসরে আয়োজিত হলো। আগের বছরগুলোতে তারা উৎসবটি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন করতেন।  

সেদিক থেকে শহরের চলচ্চিত্র অনুরাগীদের জন্যে দুইদিন ব্যাপী উৎসবটি বড় আনন্দের উৎসার ছিল। অবশ্য বাংলাদেশের শুধুমাত্র নারী চলচ্চিত্রকারদের কেন্দ্র করে আরেকটি আয়োজনের কথা পাওয়া যায় বছর পাঁচেক আগে। 

‘পুন্ড্রনগর ফিল্ম সোসাইটি’-র আয়োজনে অতিমারির বছর ‘বগুড়া উইমেন্স ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় অনলাইন মাধ্যমে। দুইদিন ব্যাপী চৌদ্দটি দেশের চৌদ্দ জন নারী চলচ্চিত্রকারের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় তাদের ফেসবুক পেজ থেকে। শুধুমাত্র নারী চলচ্চিত্রকারদের নিয়ে এমন আয়োজন বাংলাদেশে, আমার জানামতে প্রথমবার হয়েছিল ২০২০ সালে। 

আফ্রিকায় একজন কিশোরীর সামনে যাপনের প্রধান জটিলতা কি, যখন স্যানেটারী প্যাড আর পাউরুটির দাম সমান!  তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র মানুষদের পছন্দ আর প্রয়োজন সব সময় সীমিত হয়ে যায়- বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার, সাম্য এই সকল বিষয় নিয়ে দিস্তা দিস্তা প্রবন্ধ লেখার পরেও, রাশি রাশি সেমিনারের পরেও। চট্টগ্রামের ডিসি হিলের ফুল বিক্রেতা প্রাক কিশোরের পেছনে ক্যামেরা স্নেহ নিয়ে পাশে থাকে (অ্যা ফ্লাওয়ার বয় ইন ডি সি হিলস, ইউরোসিয়া গুতেরেস পেরেইরা), জেনে নিতে চায় তার ছোট্ট জীবনের কথা। সঙ্গ রহিত দশার বয়ান তুলে ধরেন মালিহা মালিয়াত (ব্ল্যাঙ্ক টেক্সটস)। গৃহকর্মীদের জীবনের অসহভার তুলে ধরতে গিয়ে সরল চিত্র ভাষার আশ্রয় নেন নাবিলা আনজুম (ফ্রম লেভেল ফাইভ)। প্রজ্ঞা পারমিতা দাশ মৃৎশিল্পীদের জীবন জানতে একটি পরিবারের খন্ড সময় উপস্থিত করেন (পটারি: অ্যা ফরগটেন আর্ট)। 

নয়নী বরগোঁঞা ঘুড়ির রূপকল্পে নিম্নবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন আর বাসনার আলেখ্য নির্মাণ করেন (চিলা…দ্য পেইন অফ ফ্লাইং)। সুরাইয়া রহমানের তথ্যচিত্রে (দ্য ইনসাইডারস, অবরোধবাসিনী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলবাসী নারীদের এক ধরণের রুদ্ধতার গল্প দেখি আমরা। পাকিস্তানের তরুণী গুলজার নয়নী গরীবাবাদ এলাকার উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানুষের অসহায়তা, প্রতিবাদ, আইনি তৎপরতার কথা আমাদের জানান। ‘অ্যাগেইনস্ট দ্য রাবেল’- এর গল্প উন্নয়নশীল দেশের আপামর মানুষদের উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ও প্রতিরোধের আমর্ম চেষ্টার বিশ্বজনীন বয়ান। আমরা যারা জাতীয়তাবাদী তৎপরতায় সমগ্র পাকিস্তানকে এই অপর করে দিয়েছি, তাদের জন্যে এই তথ্যচিত্র চেতাবনির কাজ করবে।

কর্মজীবী নারীদের শ্রমের নিত্যনৈমিত গল্প আমাদের দেশের পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতায় স্বররহিত এই কথা সুহা শেহনাজ আহমেদের ‘ভয়েসলেস ওয়ালেট’-এ জীবন স্পর্শ করে উঠে এসেছে। মল্লিকা রায় ‘প্রদোষে’ চলচ্চিত্রে এমন এক গল্প বলতে চেয়েছেন যা গল্পের কারণেই মনে স্থান করে নেয়। প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে ফিকশন ও ডকুমেন্টারি এই দুই ক্যাটাগরির তেরোটি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় সেপ্টেম্বরের চার তারিখ- একটি উজ্জ্বল, উৎসাহে ভরপুর উদ্বোধনী আয়োজন শেষে। চট্টগ্রামের আঁলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ভেন্যু থেকে প্রথমদিনের আয়োজন শেষে বেরিয়ে ‘প্রদোষে’ আর ‘অ্যাগেইন্সট দ্য রাবেল’-এর পুরষ্কারপ্রাপ্তি বিষয়ে মত প্রকাশ করেছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। চলচ্চিত্র ভাষার জন্যেই। 

‘কানেক্ট হার’ নারীবিশ্ব নিয়ে কাজ করে যাওয়া একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। ২০১৩ সালে পুজা খাটি ছোট চায়ের দোকানে সারাদিন, বিকেল, সন্ধ্যে আর অনেক রাত অব্দি বসে থাকা এক তেরো বছরের মেয়ে আসমা’র গল্প বলেছিলেন সমনামী তথ্যচিত্রে। সেপ্টেম্বরের সকালের সেশনে ‘কানেক্ট হার’ নির্বাচিত পনেরোটি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। পুজা খাটি’র ‘আসমা’ ছাড়াও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মনে রাখবার মতো কাজ আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়। ‘দ্য স্যান্ড গেম’ কিশোর কিশোরীদের ধুলোবালিতে বর বউ খেলার রূপকে ভারতীয় উপমহাদেশের পুরুষতান্ত্রিক শেকলে বাঁধা বিবাহ ব্যবস্থার ক্রিটিক করে। ‘মাদার্স ফুটবল টিম’ কর্মজীবী মায়েদের ফুটবল দল নিয়ে ছয় মিনিটের কাজ। 

ফিলিস্তিনের সুনির্বাচিত কয়েকটি চলচ্চিত্র বিকেলের সেশনে প্রদর্শিত হয়। বাস্তুচ্যুত মানুষের ব্যথা পর্দায় দেখতে অসহ ভার বোধ হচ্ছিল। যে কোনো যুদ্ধের প্রাথমিক বলি নারী ও শিশু- এই জানা কথাটি আবার মর্মের ভেতরে উপলব্ধি করলাম।  ছিন্ন দেশ আর ছিন্ন মানুষের আর্তনাদ বিশ্ববিবেকের কাছে পৌঁছবে না আমরা জানি কিন্তু নির্মাতাদের তো সত্য ধারণ করে রাখতেই হবে। 

চমৎকার এক সাংস্কৃতিক আয়োজন হয় সন্ধ্যায়। 

এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটির মিউজিক ক্লাব আমাদের প্রয়াত কিংবদন্তী আইয়ুব বাচ্চুর একটি গান অপূর্ব ভঙ্গিতে পরিবেশন করেন। ড্যান্স ক্লাব, এইউডব্লিউ কয়্যার- তাদের পরিবেশনায় উপস্থিত শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। বাংলা মিউজিক ক্লাবের শিল্পীরা রবীন্দ্রগানকেই বেছে নিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল, অল্পবয়সী এসব শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছেন। 

উৎসব স্মারক ও পুরষ্কার বিতরণের সন্ধ্যাটি আমাদের তরুণ নারী নির্মাতাদের উচ্ছ্বল চিৎকার আর আনন্দে ভরা ছিলো। মাননীয় সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অসুস্থ শরীর নিয়েও ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। আশা প্রকাশ করেন, পরেরবার দায়িত্বে না থাকলে তিনি সামিল হবেন এই আয়োজনে। বাংলাদেশ ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য, চলচ্চিত্র পরিচালক রফিকুল আনোয়ার রাসেল আমাদের শহরের দীর্ঘদিনের পরিচিত মুখ। তার কথা আমাদের নিত্য সাহসের যোগানদার। তারকোভস্কিকে উদ্ধৃত করে তিনি সাহস না হারাতে বলেন নির্মাতাদের।

দুইদিন ধরে আমাদের পুরনো বন্ধু, এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, নির্মাতা ও এই উৎসব পরিচালক মাসুদূর রহমানের পরিশ্রম চোখে আর মনে লেগে থাকার মতো ছিল। আমার পূর্ব ধারণা অনুযায়ী,  মল্লিকা রায়ের ‘প্রদোষে’ ফিকশন বিভাগের শ্রেষ্ঠত্বের পুরষ্কার জেতে। আর, ডকুমেন্টারি বিভাগে গুলজার নয়নী’র ‘অ্যাগেইস্ট দ্য রাবেল’ জুরি বোর্ডের বিচারের শ্রেষ্ঠ ছবির সম্মান পায়। জুরি বোর্ডে নরওয়ের ট্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসামি সাইতো আর সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী ডক্টর টিফানি কোনের মতো বিচারকেরা ছিলেন। ফলে, তাদের সাথে নিজের চিন্তা মিলে যাওয়ায় নন্দনের আনন্দ পেয়েছি। 

বিশেষ করে বলবার, উৎসব স্মারক ক্যাটালগ, টোট ব্যাগ আর টি শার্ট-  পড়তে, কাঁধে নিতে আর পরতে ভালো লেগেছে। স্মৃতির বস্তুগত সঞ্চয় হিসেবে সুন্দর। দর্শকদের সংখ্যা ছিল আশাব্যঞ্জক। তবে, অধিকাংশই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শহরের  চলচ্চিত্র সেবকদের অনেকেই অনুপস্থিত ছিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিনম্র আচরণ দেখে মনে হলো, আমাদেরও এমন শান্ত হতে হবে আরও। ভবিষ্যতের আয়োজন আরও বড় পরিসরে, সবার উপস্থিতিতে অধিকতর আলো ছড়াবে, এইটুকু আশা আমরা করতেই পারি।

You may also like

Leave a Comment