রাস্তার একপাশে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় শপিং মলগুলোর একটি, নামকরা সব ব্র্যান্ডের পণ্য সেখানে হাতের নাগালে। অথচ জুতা কিনতে মানুষের ভিড় অন্যপাশের ফুটপাতে!
স্থানটি পান্থপথ। কারওয়ানবাজার মোড় থেকে একটু সামনে এগোলেই বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স। এর ঠিক বিপরীত দিকের ফুটপাতে কিছু জুতার দোকান। বেশিরভাগই অস্থায়ী। ওপরে প্লাস্টিকের ছাউনি দেয়া। নিচে কাঠের তাকে বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো।
এই দোকানগুলোর বেশ নামডাক ক্রেতাদের মধ্যে। কারণও আছে যথেষ্ট। এখানে পাওয়া যায় খাঁটি চামড়ার জুতা, যেগুলোর দাম হাতের নাগালে। বড় বড় সব ব্রান্ডের জুতা এই ফুটপাতে বিক্রি হয় অর্ধেকেরও কম দামে!
খাঁটি চামড়া, আসল জুতা
রুবেল হোসেন কাজ করেন এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। নয়টা-পাঁচটা অফিস। কেতাদুরস্ত হয়ে অফিস যেতে হয় সপ্তাহে ৬ দিন। অফিসের পোশাকেই তিনি এসেছেন পান্থপথে। উদ্দেশ্য, একজোড়া জুতা কেনা।
কিছুক্ষণ দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। তার দরকার ফর্মাল জুতা। তা শোরুমে নয় কেন? সেখান থেকে একদফা ঘুরে এসেছেন অবশ্য। কিন্তু মাসের শেষ, হাত খালি; অগত্যা পান্থপথ!
ফুটপাত কিন্তু তাকে হতাশ করেনি। জুতোর এত এত বাহার দেখে উল্টো পড়েছেন দ্বিধায়। শেষমেশ ১,৬০০ টাকায় একজোড়া ‘অক্সফোর্ড শু’ পেয়ে গেলেন। জুতাজোড়ার একটিতে গোড়ালির দিকের চামড়ায় সামান্য ভাঁজ। তবু নিশ্চিত জিত রুবেল হোসেনের। তার ভাষায়, ওইটুকু খুঁত এড়িয়ে গেলে জুতোজোড়া একেবারে ‘ফাটাফাটি’! ‘প্রমোশন না হওয়া পর্যন্ত শোরুমে যাচ্ছি না আর’—হাসতে হাসতে এমনই কিছু একটা বললেন তিনি।
জুতোর এই অস্থায়ী মার্কেটটি এভাবেই হাসি ফোটাচ্ছে ক্রেতাদের মুখে। করোনা প্রাদুর্ভাবের পরপরই এর উত্থান। দোকান আগেও ছিল। তবে ক্রেতাদের ভরসা অর্জনের গল্পটি ৩-৪ বছরের।
কী বিশেষত্ব এই ফুটপাতের? ‘এক্সপোর্ট কোয়ালিটির জুতা পাওয়া যায়। যে জুতা শোরুমে ৫-১০ হাজার টাকা, এই মার্কেটে সেই জুতা পাবেন ২ হাজার টাকায়। ফর্মাল জুতা, বুট, লোফার, ক্যাজুয়াল, সব ধরনের এক্সপোর্ট কোয়ালিটির আইটেম এত কম দামে আর কোনো মার্কেটে পাবেন না,’ একটি দোকানের কর্মচারী আব্দুল হোসেন জানালেন।
ইপিজেড থেকে পান্থপথ
জুতোগুলোর যাওয়ার কথা ছিল উন্নত কোনো দেশে অথবা শোভা পাওয়ার কথা দেশেরই নামিদামি শোরুমে। কীভাবে এলো এই ফুটপাতে?
ইশরাক হোসেন এই মার্কেটে কাজ করেন আজ প্রায় এক দশক হলো। তার বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। কৈশোরে এসেছিলেন কর্মচারী হিসেবে। এখন নিজেই মহাজন। মার্কেটের শুরুর দিকেই তার দোকান। ইশরাক জানালেন, অনেক নামিদামি ব্রান্ডের জুতা এখানে পাওয়া যায়, যেগুলো হয়তো বিদেশিরাই বেশি ব্যবহার করে। ‘রেডটেপ-এর ক্যাজুয়াল জুতা, লাসোকির ফর্মাল, এয়ার জর্ডানের “এ” গ্রেড সু পাওয়া যায়। আরও অনেক নাম, সব আমি জানিও না, কাস্টমাররা আরও ভালো চিনেন,’ বললেন ইশরাক।
জুতাগুলো সংগ্রহের ব্যাপারে কথা হলো আরেক মহাজন খোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি ২০১৪ সাল থেকে এই মার্কেটে ব্যবসা করছেন। এখানকার বড় মহাজনদের মধ্যে তিনি একজন। তার দোকানের নাম আরিফ ট্রেডার্স।
খোরশেদ জানালেন, ইপিজেড আর ফ্যাক্টরিগুলো থেকে রপ্তানিপণ্য কেনার সময় সামান্য কোনো খুঁত পেলেই তা বাতিল করে দেন বিদেশি ক্রেতারা। আবার ফ্যাক্টরিতে উৎপাদনের সময়ে কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে সেগুলোও আর বাইরে পাঠানো যায় না। এসব পণ্যই চলে আসে ঢাকার ফুটপাতগুলোতে। ঢাকার অনেক ফুটপাত মার্কেটের মতই পান্থপথ এসব পণ্য বিকিকিনির জায়গা। তবে তাদের এই মার্কেটের বিশেষত্ব চামড়ার জুতা।
পান্থপথের মহাজনেরা এসব পণ্য কিনে আনেন চট্টগ্রাম রোডের কারখানাগুলো থেকে। ‘বিভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে জুতা আইসা চট্টগ্রাম রোডের কারখানায় জমা হয়। আমরা পরে নিলামে কিনা আনি। তিনটা গ্রেডের জুতা থাকে। “এ” গ্রেড আমরা রাখি, “বি” গ্রেড আর “সি” গ্রেড অন্য ফুটপাতে পাঠিয়ে দেই,’ বললেন খোরশেদ আলম।
ক্রেতাদের বড় অংশ চাকরিজীবী-শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিটন ইসলাম এই মার্কেটের নিয়মিত ক্রেতা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ভাইভা দিয়েছিলেন এখান থেকে কেনা জুতা পরে। জানালেন, গত শীতেও একজোড়া লোফার কিনেছিলেন। প্রায় নিয়মিত ব্যবহার করেন, এখনও দিব্যি চলে যাচ্ছে।
এই মার্কেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ব্লেসিং’ (আশীর্বাদ) বলে মনে করেন তিনি। ‘ছাত্রদের তো আর এপেক্স-লোটো থেকে জুতা কেনার টাকাপয়সা থাকে না। ৪-৫ হাজার টাকা দিয়ে অরিজিনাল চামড়ার জুতা কেনার কথা আমাদের ভাবতেও কষ্ট হয়। ১,২০০–১,৫০০ টাকায় এখানে ফর্মাল জুতা পাচ্ছে সবাই। এটা তো আসলে ভালো একটা সুযোগ,’ বললেন লিটন।
খোরশেদ আলম জানালেন, পুরুষদের প্রায় সব ধরনের জুতা পাওয়া যায় এই মার্কেটে। তবে চামড়ার ফর্মাল জুতা আর বুটের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই তরুণ ক্রেতাদের কাছে মার্কেটের জনপ্রিয়তা অত্যধিক। ‘অফিস করতে হলে তো আপনের একজোড়া ফর্মাল জুতা লাগবেই। ভালো মানের বুট পাওয়া যায়। অনেক টেকসই, নিশ্চিন্তে ২-৩ বছর ব্যবহার করতে পারবেন। ছাত্ররাও অনেক আসে।’ তবে নারীদের জন্য এক ‘বুট’ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। ফলে তাদের উপস্থিতিও কম এই ফুটপাতে।
একজোড়া ভালো মানের ফর্মাল জুতোর দাম এখানে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা। লোফারের দাম শুরু হয় মাত্র ১ হাজার থেকে। একটু ভালো মানের চাইলে খরচ করতে হয় ১,০০–১,৫০০ টাকা। বুটের দাম একটু বেশি। ৩ হাজারে টেকসই একজোড়া বুট কেনা যাবে এই ফুটপাত থেকে। এক্সপোর্টের জুতা ছাড়াও কিছু চাইনিজ আর দেশীয় কমদামি পণ্যও পাওয়া যায়। বিক্রেতারা বলছেন, একটু কম বাজেটের মধ্যে যারা কিনতে চান, তাদের কথা ভেবেই এগুলো রাখেন। তবে ক্রেতাদের বলে দেয়া হয়, কোনটি এক্সপোর্ট আর কোনটি স্থানীয় পণ্য।
মার্কেট নিয়ে ক্রেতাদের অভিমতও বেশ ইতিবাচক। একজন জানালেন, এখানে ইচ্ছেমতো দামাদামি করা যায়। ঢাকার অন্য অনেক ফুটপাতের মতো এখানে ক্রেতাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয় না।
মূল ব্যবসা শীতে
শীতকালে জুতার ব্যবহার বেড়ে যায়। ফলে সে সময়েই জমে ওঠে এই মার্কেট। গরমের সময়ে সারাদিনে ২-৩ জোড়া জুতা বিক্রি করতে গলদঘর্ম হতে হয় বিক্রেতাদের, সেখানে শীতে বিক্রি হয় কম হলেও ১০-১২ জোড়া!
ইশরাক হোসেন জানালেন, শীত শুরু হতে না হতেই বেচাকেনা বেড়ে যাবে তাদের। চলবে একেবারে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত। ‘শীতে অনেক বেশি বিক্রি হয়। রোজার মাসটা আবার মন্দা যায়। এরপর দুই ঈদের সামনে বেচাকেনা বাড়ে।’